top of page

"নব আশ্রয়" এর প্রতিষ্ঠাতা

mainuddin_sk.jpg
মাইনুদ্দিন সেখ

এ পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে 


মামুলি একটা সাদামাটা লোক। দেখতে আটপৌরে আম পাবলিকই বটে। এক লহমায় তাঁকে দেখলে এমনটাই মনে হবে। তবু তিনি অনন্য। জমাট বাঁধা নিকষ কালো মেঘের গর্ভে যেমন লুকানো থাকে বজ্র নির্ঘোষ, তেমনটাই তিনি। চরাচরের আঁধার চিরে যেমন বিদ্যুৎ রেখা চতুর্দিকে তার নিজের উপস্থিতি জানান দেয়, তেমন ভাবেই প্রায় সাড়ে চার দশক আগে, তাঁর নিজের কিশোরবেলায় মাইনুদ্দিন শেখের মহানুভবতা অনুভব করে লালগোলা ও কলকাতাও।  'ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো'র তাঁর হাতেখড়ি, তখন তিনি নবম শ্রেণির কিশোর। তাঁরই সমবয়সি এক কিশোরকে লালগোলা বাজারে ঘুরে বেড়াতে দেখে মাইনুদ্দিনের মনে সংশয় জাগে। অবশেষে জানতে পারেন, ভবঘুরে কিশোরের নাম কবীর কাজি। বাড়ি কলকাতা। কবীরকে তার কলকাতার বাড়িতে পৌঁছে দেন মাইনুদ্দিন। পরোপকারে তাঁর হাতেখড়ি এভাবেই। লালগোলা রেলস্টেশন থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে প্রসাদপুর গ্রামের ধনীচাষি পরিবারে মাইনুদ্দিন শেখের জন্ম। 

পদ্মাপাড়ের লালগোলায় দেশের সীমান্ত রেলস্টেশন। সেখান থেকে দু' কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণপুর স্টেশনে আছে লোকোশেড। এটা ট্রেনের বিশ্রামাগার। এখানেই ট্রেনের ইঞ্জিন চেঞ্জ করা হয়। ফলে পূর্বরেলের শিয়ালদহ বিভাগের কৃষ্ণনগর-লালগোলা শাখার ট্রেনের সওয়ারি ভবঘুরে ও মানসিক ভারসাম্যহীনদের বরাবরের আশ্রয় লালগোলা ও কৃষ্ণপুর স্টেশন দু'টি। আশ্রয় তো হল, কিন্তু পেটের দানাপানি?

পেটের দায়ে হাত পাতলে খাবারের দোকানের গরম তেল, ফুটন্ত জল ও লাঠির আঘাতের মতো অনেক কিছুই, অতি সহজেই, ওই অসহায়দের শরীরে বরাদ্দ হয়। সেই দৃশ্য অনেকের কাছেই জলভাত ও প্রতিক্রিয়াহীন হলেও মাইনুদ্দিন কিন্তু ব্যাতিক্রমী। ফলে তিনি প্রতিক্রিয়াহীন হতে পারেননি। মন কেঁদেছে। তিনি একাধারে ইটভাটার মালিক, আবার সম্পন্ন চাষিও বটে। অতঃপর মাইনুদ্দিন নিজস্ব অর্থ খরচ করে লালগোলা ও কৃষ্ণপুর স্টেশনে, লালগোলা বাজারে ও হাসপাতাল চত্বরে আশ্রয় নেওয়া ভবঘুরে ও মানসিক ভারসাম্যহীনদের দু' বেলা পেটপুরে খাবারের ব্যবস্থা করেন তিনি।


কেবল খাবারই নয়, লালগোলার কৃষ্ণপুর গ্রামীন হাসপাতালে, লালবাগ মহকুমা হাসপাতালে ও বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওই অসহায়দের ভর্তি করে, তিনি তাঁদের সুস্থ করে তোলার ব্যবস্থাও করেন। দুর্গাপুজোর সময় তাঁদের প্রতিমা দর্শনেরও ব্যবস্থা করেন ষাটোর্ধ স্নাতক মাইনুদ্দিন। বহু চেষ্টায় ভবঘুরেদের কাছ থেকে অসম্পূর্ণ ঠিকানা জোগাড় করে 'টিম মাইনুদ্দিন'। গুগুলের সাহায্য নিয়ে সেই অসম্পূর্ণ ঠিকানা থেকে 'টিম মাইনুদ্দিন' সম্পূর্ণ ঠিকানা উদ্ধার করে ওই অসহায়দের বাড়ি পৌঁছে দেয়। 


ওই তালিকায় আছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা থানার ৮১ বছরের বৃদ্ধা সন্ধ্যারানি গুছাইত, উত্তর প্রদেশের বরেলি জেলার হাফিজগঞ্জ থানার ধর্মেন্দ্র কুমার, মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জ থানার উসমানপুর গ্রামের ষাটোর্ধ কালীদাসীদের মতো অনেকে। ফলে লালগোলায় এমন অসহায় মানুষের দেখা মিললেই খবর যায় মাইনুদ্দিনের কাছে। অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির দেহ সৎকারের জন্যও পুলিশ ও হাসপাতাল থেকে ডাক পড়ে মাইনুদ্দিনের। থানা ও হাসপাতালের তখন মাইনুদ্দিনই মুশকিল আসান।


 এই মহৎপ্রাণ মানুষটি অতি সম্প্রতি অভিনব একটি উদ্যোগে হাত লাগিয়েছেন। পথভোলা মানুষদের শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষার দুর্গতি থেকে রক্ষা করতে নিজের ১০ কাঠা জমিতে এই ব্যাতিক্রমী মানুষটি নির্মাণ করেছেন 'নব আশ্রয়' নামের একটি আবাসন। সেখানে পথভোলা ৩০-৩৫ জন মানুষের থাকা-খাওয়া-শোয়ার মতো অসাধারণ ব্যবস্থা করেছেন অতি সাধারণ ভাবে যাপন করা এই অনন্য মনের মানুষটি।

bottom of page